আমরা অনেকেই বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রের নাম শুনেছি যেমন- গয়া, কাশি, বৃন্দাবন, ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে অনেকে আবার এসব তীর্থক্ষেত্র ভ্রমণও করেছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এসকল স্থান কীভাবে তীর্থ- ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে তা আমরা অনেকেই জানিনা। তীর্থক্ষেত্রগুলো সর্ম্পকে অনেক পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে। আজ আমরা এরকমই একটি গল্প পড়ব।
পুরাকালে দক্ষ নামে এক প্রবল পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। ব্রহ্মার বরে তিনি প্রজাপতিদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার ক্ষমতা পান। একবার তিনি দেবী মহামায়াকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করে এই বর চান যে, মহামায়া যেন তাঁর ঘরে কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষের এই প্রার্থনা পূরণ করতে মহামায়া সম্মত হন। কিন্তু তিনি একটি শর্তও জুড়ে দেন- দক্ষ তাঁর প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করলে তিনি প্রাণত্যাগ করবেন। অতঃপর রাজা দক্ষ এবং রানি প্রসূতির ঘরে সতীর জন্ম হয়। তাঁদের ষোলোটি কন্যা ছিল। তাঁদের মধ্যে সতীদেবী ছিলেন দেবী মহামায়ার মনুষ্যরূপ। পরবর্তীতে মহাদেবের সাথে সতীদেবীর বিবাহ হয়। এদিকে জামাতা শিব দক্ষরাজকে মোটেই সম্মান করতেন না।
একবার দেবতারা এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করলেন। দক্ষ সেখানে এলে উপস্থিত প্রজাপতিরা দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানান। কিন্তু শিব দাঁড়ালেন না। জামাতা শিবের আচরণে দক্ষ অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। ক্ষুব্ধ দক্ষ বাড়ি ফিরে বৃহস্পতি-যজ্ঞের আয়োজন করেন। সেখানে দক্ষের কন্যারা স্বামীসহ নিমন্ত্রিত ছিলেন। কেবল সতী আর শিবকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। পিতার এই বৈষম্যমূলক আচরণে সতী রুষ্ট হয়ে একাই বিনা নিমন্ত্রণে পিতার যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হন। দাম্ভিক দক্ষ তখন সতীকে অপমান করেন। সতীর সামনেই শিবের নিন্দা করতে থাকেন। স্বামী-নিন্দা শুনে সতী যজ্ঞস্থলেই প্রাণত্যাগ করেন। জানতে পেরে মহাদেব শিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। শোকে, ক্ষোভে তিনি নিজের মাথার জটা ছিন্ন করে ভূমিতে ফেলে দেন। ছিন্নজটা থেকে বীরভদ্ররূপে শিবের একটি উগ্ররুপের উদ্ভব হয়। শিবের অনু- চরদের সঙ্গে নিয়ে বীরভদ্র যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে যজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে দেন। বীরভদ্রের অস্ত্রের আঘাতে দক্ষের মাথা কাটা পড়ে। তারপর শিব যজ্ঞস্থলে এসে সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। নৃত্যের তাণ্ডবে পৃথিবী রসাতলে যায় যায় অবস্থা! এ অবস্থা থেকে রক্ষা করতে বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে শিবের কাঁধে থাকা সতীর দেহকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে থাকেন। সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে বিভক্ত হয়। খণ্ডগুলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় পতিত হয়। যেসব জায়গায় সতীর দেহখণ্ড পড়েছে সেই জায়গাগুলোকে বলা হয়, শক্তিপীঠ বা মহাপীঠ। |
ছক ২.১২: শক্তিপীঠের অবস্থান
প্রধান প্রধান শক্তিপীঠ | অবস্থান |
|
|
এই যে আমরা প্রধান প্রধান শক্তিপীঠগুলোর তালিকা করলাম, এসব জায়গা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থস্থান। কারণ এখানে সতীদেবীর ছিন্ন শরীরের অংশ পড়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন মহাপুরুষের জন্মস্থান, মন্দির, আশ্রম, ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ঐতিহাসিক স্থান ইত্যাদি কারণে একটি স্থান তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। এই তীর্থস্থানগুলোকে ধর্মস্থানও বলে। ধর্মস্থানগুলো ধর্মীয় দিক থেকে পবিত্রস্থান। ধর্মচর্চার স্থান। হিন্দুধর্মে অনেক মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে।
তাঁদের এবং তাঁদের ধর্মমতকে কেন্দ্র করে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ভক্তরা পুণ্য অর্জনের জন্য, ধর্মচর্চার জন্য সেখানে আসেন। হিন্দুধর্মের নানা উৎসবের পাশাপাশি মহাপুরুষের জীবনকেন্দ্রিক নানা উৎসবও সেখানে পালিত হয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে সেখানে গড়ে উঠেছে আবাসনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। সবকিছু মিলে এসব স্থানকে বলা হয় ধর্মস্থান।
আবার হিন্দুধর্মের পৌরাণিক কাহিনির সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো পবিত্রস্থান বা তীর্থক্ষেত্রে মন্দিরসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সেখানেও ধর্মচর্চা হয়। নানারকমের উৎসব হয়। দর্শনার্থী ও ভক্তদের সমাগম ঘটে। এ সকল স্থানকেও ধর্মস্থান বলা হয়।
ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের নানা ধর্মস্থান আছে। বাংলাদেশেও বেশকিছু রয়েছে- পাবনায় সৎসঙ্গ, হরিচাঁদ ঠাকুরের ওড়াকান্দিধাম, সিলেটের চৈতন্যদেবের আদি পিতৃভুমি, সীতাকুন্ডে চন্দ্রনাথধাম, রাজশাহীতে ক্ষেতুড়িধাম, নারায়ণগঞ্জে লাঙ্গলবন্ধ, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বারদীধাম ইত্যাদি। এখানে আমরা জানব, দক্ষযজ্ঞের পৌরাণিক কাহিনি-ভিত্তিক বাংলাদেশের ছয়টি শক্তিপীঠ এবং ভারতবর্ষের সুপ্রসিদ্ধ চারটি ধাম, যা চতুর্ধাম নামে প্রসিদ্ধ।
বাংলাদেশের ছয়টি শক্তিপীঠ।
সতীর দেহখণ্ড পতিত হয়ে তৈরি হয়েছিল একান্নটি শক্তিপীঠ। এর মধ্যে ছয়টির অবস্থান বাংলাদেশে। এই পীঠস্থানগুলোর নাম- সুগন্ধা, ভবানী, জয়ন্তী, মহালক্ষ্মী, অপর্ণা ও যশোরেশ্বরী।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর গ্রামে সুগন্ধা নদীর পশ্চিম পাড়ে সুগন্ধা শক্তিপীঠের অবস্থান। সতী দেবীর নাসিকা এখানে পড়েছিল। নাসিকা যেহেতু গন্ধ নেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাই এই পীঠের নাম দেওয়া হয় সুগন্ধা। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-
সুগন্ধায় নাসিকা পড়িল চক্রহতা।
এ্যাম্বক ভৈরব তাহে সুনন্দা দেবতা।।
নদীর অন্য পাড়ে আছে শিবের ভৈরব অবতার 'এ্যম্বক' এর মন্দির।
জনশ্রুতি অনুযায়ী এই মন্দির প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। এখানে পুরোনো মন্দিরের জায়গায় নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। পঞ্চচূড়া বিশিষ্ট নতুন মন্দিরের সর্বোচ্চ চূড়ার নিচে মূল গর্ভগৃহে দেবী সুগন্ধা রয়েছেন। স্থানীয়ভাবে দেবী এখানে 'উগ্রতারা' নামে পূজিতা।
এখানে দেবীর নিত্যপূজা হয়। আবার প্রতি অমাবস্যায় বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সুগন্ধাপীঠের সবচেয়ে বড় উৎসব শিবচতুর্দশী। তখন মহাধুমধামে শিবপূজা হয়। দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থী এখানে আসেন।
বরিশাল শহরের নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসযোগে ইসলাবী যেতে হয়। সেখান থেকে রিকশা-ভ্যানে সহজেই সুগন্ধা শক্তিপীঠে যাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপর রয়েছে ভবানী শক্তিপীঠ। সীতাকুন্ড বাজার থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পূর্বে চন্দ্রনাথ পাহাড়। এর চূড়ায় ভবানী শক্তিপীঠের অবস্থান। স্থানীয়দের কাছে যা চন্দ্রনাথ শক্তিপীঠ নামে পরিচিত। এখানে দক্ষকন্যা সতীর ডান হাত পড়েছিল। ভবানী শক্তিপীঠের পাশে শিবের ভৈরব অবতার 'চন্দ্রশেখর' নামে পূজিত। অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে- চট্টগ্রামে ডানি হস্ত অর্ধ অনুভব। ভবানী দেবতা চন্দ্রশেখর ভৈরব ।।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সৌন্দর্য অতি মনোরম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার ফুটেরও বেশি উঁচু এই পাহাড়। চারিদিকে পাহাড়ি বন। পাহাড়ের পশ্চিম দিকে বিশাল সমুদ্র। বিশ্রাম নিয়ে ধাপে ধাপে পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে হয়। ভবানী শক্তিপীঠ ছাড়াও এখানে চন্দ্রনাথ শিবের মন্দির, মহাপুরুষকেন্দ্রিক নানা মন্দির, ধর্মশালা ইত্যাদি রয়েছে।
দেশবিদেশ থেকে বহু সাধু-সন্ন্যাসী ও পুণ্যার্থী এখানে আসেন। পাপমোচন বা মনকে পবিত্র করার জন্য ভক্তদের আগমন ঘটে। এখানে দেবীর নিত্যপূজা হয়। ভবানী শক্তিপীঠের সবচেয়ে বড় উৎসব শিবচতুর্দশী। উৎসব উপলক্ষে এখানে মেলা বসে। চট্টগ্রাম শহরের অলঙ্কার মোড় বা কদমতলীর মোড় থেকে ঢাকা- চট্টগ্রামগামী বাসে সীতাকুন্ড বাসস্টপেজ পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে টেম্পু বা অটোরিকশাযোগে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে যাওয়া যায়। দীর্ঘসিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছোলে দেবীর পীঠস্থানের দর্শন মেলে।
সিলেট জেলার কানাইঘাট থানার কালাজোড় বাউরভাগ গ্রামে জয়ন্তী শক্তিপীঠের অবস্থান। এখানে সতীদেবীর বাম উরু পড়েছিল। জয়ন্তী শক্তিপীঠের পাশেই শিবের অবতার ভৈরব ক্রমদীশ্বর নামে পূজিত। অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-
জয়ন্তায় বাম জঙ্ঘা ফেলিলা কেশব। জয়ন্তী দেবতা ক্রমদীশ্বর ভৈরব।।
এই পীঠে একটি চারকোণা অগভীর গর্তে একটি পাথরখণ্ড আছে। পাথরখণ্ডটির আকৃতিও চারকোণা। লোকশ্রুতি আছে, এ পাথরখণ্ডটি সতীর বাম উরুর রূপান্তরিত রূপ। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী ও ভৈরব ক্রমদীশ্বর একই কূপে একই সাথে বিরাজ করেন। জনৈক জমিদার এ পাথরের অলৌকিকত্ব জানতে পেরে এখানে মন্দির নির্মাণ করেন। পাশে অন্য একটি অগভীর কূপ আছে। যার জল অতি স্বচ্ছ। সেই জলেই দেবীর পূজা হয়।
পীঠস্থানকে কেন্দ্র করে এখানে নাটমন্দির, শিবমন্দির, সানবাঁধানো দীঘি নির্মিত হয়েছে। প্রতিবছর চৈত্র মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে এখানে মায়ের পূজা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বহু দর্শনার্থী ও পুণ্যার্থী তখন এখানে আসেন।
জয়ন্তীপীঠে যেতে হলে সিলেট থেকে বাসযোগে প্রথমে চতুলবাজার, চতুলবাজার থেকে অটোরিকশাযোগে শলৈঘাট হয়ে কালাজোড় বাউরভাগে যেতে হবে। এখানেই দেবীর দর্শন পাওয়া যায়।
সিলেট জেলার আর একটি শক্তিপীঠের নাম মহালক্ষ্মী। সিলেট শহরের তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে দক্ষিণ সুরমায়, সিলেট- ফেঞ্চুগঞ্জ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে জৈনপুর গ্রামে এই পীঠের অবস্থান। এখানে সতী দেবীর গ্রীবা (গলা) পতিত হয়। তাই একে গ্রীবা-মহাপীঠও বলা হয়। দেবীর গ্রীবা পড়েছিল একটি শৈলখণ্ডের উপর। সেই শৈলখণ্ডই দেবীরূপে পূজিত। মহাদেব ভৈরব এখানে সর্বানন্দ নামে পূজিত। অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-
শ্রীহট্টে পড়িল গ্রীবা মহালক্ষ্মী দেবী।
সর্বানন্দ ভৈরব বৈভব যাহা সেবি।।
পুরাতন মন্দিরের পরিবর্তে এখানে নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। যা অত্যন্ত কারুকার্য খচিত, প্রশস্ত ও দৃষ্টিনন্দন। এখানে নবরাত্রি উৎসব মহাসমারোহে উদ্যাপিত হয়। তখন দেশ-বিদেশ থেকে বহু ভক্তের সমাগম ঘটে।
সিলেট শহরের কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল থেকে মোগলাবাজার রোড ধরে রিকশা, ভ্যান বা অটোরিকশায় তিন কিলোমিটার গেলেই মহালক্ষ্মী শক্তিপীঠে পৌঁছোনো যায়।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে অপর্ণা শক্তিপীঠের অবস্থান। দেবীর বাম পায়ের গোঁড়ালি বা বাম কান এখানে পড়েছিল। মহাদেবের অবতার ভৈরব এখানে বামন নামে পূজিত। অন্নদামঙ্গলে বলা হয়েছে-
করতোয়া তটে পড়ে বাম কর্ণ তাঁর।
বামেশ ভৈরব দেবী অপর্ণা তাঁহার ।।
এই পীঠস্থানে অনেকগুলো পুকুর রয়েছে। যার মধ্যে বিখ্যাত শাঁখারী-পুকুর। নাটোরের মহারানি ভবানীকে এই পুকুরের মধ্যে শাঁখা-পরিহিতা অবস্থায় দেবী দেখা দিয়েছিলেন, এমন লোকশ্রুতি রয়েছে। ভক্তরা তাই পাপমোচনের জন্য এই পুকুরের জলে স্নান করেন। শিবমন্দির, নাটমন্দির, গোপালমন্দির, ভোজনশালা- সব মিলে পীঠস্থানটি গড়ে উঠেছে। দুর্গাপূজা, শ্যামাপূজা, রামনবমী, মাঘীপূর্ণিমা ইত্যাদি উৎসব সাড়ম্বরে এখানে পালিত হয়। দূরদূরান্ত থেকে পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীরা তখন এখানে আসেন।
বগুড়া থেকে বাসযোগে শেরপুর এবং শেরপুর থেকে রিকশা বা ভ্যানে করে সহজেই অপর্ণা শক্তিপীঠে পৌঁছানো যায়।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠ অবস্থিত। যশোরেশ্বরী অর্থ যশোরের ঈশ্বরী। অর্থাৎ যশোরের দেবী। এখানে দেবীর হাতের তালু ও পায়ের পাতা পতিত হয়। মহাদেব শিবের অবতার ভৈরব চন্ড নামে এখানে পূজিত। এখানকার পীঠের মূল মন্দির, শিবমন্দির, পুকুর সবই ত্রিকোণাকৃতি। এই পীঠস্থানে নিত্যপূজা হয়। সবচেয়ে বড় উৎসব শ্যামাপূজা। পূজা উপলক্ষে মেলা বসে। দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা উৎসবে যোগ দেন। মন্দিরের পাশে মসজিদ, গীর্জা প্রভৃতির অবস্থান সর্বজনীনতা প্রমাণ করে।
সাতক্ষীরার কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল থেকে বাসযোগে শ্যামনগর এসে রিকশা-ভ্যানে করে যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠে পৌঁছানো যায়।
'ধাম' শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিবাস, আশ্রয়স্থল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে দেবতার অধিষ্ঠিত নিবাসস্থলই ধাম। অলৌকিক ধর্মীয় কাহিনি বা মহাপুরুষদের জীবন-লীলার সাথে যুক্ত পুণ্যভূমিকেও ধাম বলা হয়। ভক্তরা নিজের পাপমোচন, পুণ্য অর্জন, সর্বোপরি নির্মল প্রশান্তি লাভের জন্য ধামে আসেন। ধামে এসে সংসারে আবদ্ধ জীবের মনের নানা জটিলতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যায়। ধামগুলোকে তাই পুণ্যভূমি, তীর্থক্ষেত্র বা মোক্ষভূমিও বলা হয়। ধামের মূল দেবতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মন্দির। আবার, আগত ভক্তদের সুবিধার্থে সেখানে আবাসন, রন্ধনশালা, ভোজনালয়, ধর্মশালা ইত্যাদির ব্যবস্থাও থাকে। এ সব প্রতিষ্ঠানকে একসাথে ধাম বলা হয়।
হিন্দুধর্মে অনেক ধামের উল্লেখ আছে। ধামগুলোর মধ্যে চারটি ধাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- বদ্রীনাথধাম, রামেশ্বরমধাম, দ্বারকাধাম এবং জগন্নাথধাম। এদেরকে একসাথে চতুর্ধাম বলা হয়। ভারতবর্ষের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চার প্রান্তসীমায় চারটি ধামের অবস্থান। ভারতের মানচিত্রকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের দিক থেকে সমান দুই ভাগ করে একটি গাণিতিক যোগ-চিহ্ন (+) আঁকা হলে চিহ্নের বাহুগুলোর শীর্ষপ্রান্তে ধামগুলোর অবস্থান। বদ্রী- নাথধাম ভারতের উত্তর সীমানায়, রামেশ্বরমধাম দক্ষিণ সীমানায়, দ্বারকাধাম পশ্চিম সীমানায় এবং জগন্নাথ- ধাম পূর্ব সীমানায় অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে বদ্রীনাথধাম সত্যযুগের, রামেশ্বরমধাম ত্রেতাযুগের, দ্বারকাধাম দ্বাপরযুগের এবং জগন্নাথধাম কলি যুগের কাহিনির সাথে যুক্ত। তীর্থক্ষেত্রের পাশাপাশি ধামগুলো দর্শনীয় স্থান হিসেবেও মনোরম।
ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলার একটি শহর বদ্রীনাথ। শহরের গাড়োয়াল পার্বত্য এলাকায় অলকানন্দা নদীর ধারে বদ্রীনাথধাম অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার মিটার উচ্চতায় এই ধামের অবস্থান। ভগবান বিষ্ণু এখানে বদ্রীনারায়ণ-রূপে পূজিত। স্থানীয়রা এই ধামকে 'দীব্যদেশম' বলেন। তাঁদের বিশ্বাস ভগবান বিষ্ণু এখানে জাগ্রত অবস্থায় রয়েছেন।
দীর্ঘ সিঁড়ি অতিক্রম করে মূল মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরটি তিন ভাগে বিভক্ত- সভাম- গুপ, দর্শনমণ্ডপ ও গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহে চাঁদোয়ার নিচে বদ্রীনায়ায়ণের চতুর্ভুজ মূর্তি স্থাপিত। কষ্টিপাথরের এই মূর্তির উচ্চতা এক মিটার। উপরের দুই হাত উত্তোলিত অবস্থায় শঙ্খ ও চক্র ধারণ করা। নিচের দুই হাত যোগমুদ্রায় ও পদ্মাসনে স্থিত।
মন্দিরের একদিকে নরপর্বত এবং বিপরীত দিকে নারায়ণ-পর্বত। মন্দিরে রয়েছে তপ্তকুন্ড নামে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ। ভক্তদের বিশ্বাস কুন্ডের জলে স্নান করলে রোগমুক্তি হয়। পাহাড়ি পরিবেশ, বহমান অলকানন্দা নদী- সব মিলে বদ্রীনাথধামের পরিবেশ অতি মনোরম। রাতের আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে তা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।
লোকশ্রুতি অনুসারে, শঙ্করাচার্য এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অলকানন্দা নদী থেকে বদ্রীনাথের মূর্তি উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে বদ্রীনাথধামে ভক্তদের সমাগম বাড়তে থাকে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, বদ্রীনাথধামের প্রকৃত নাম বদরিকা-ধাম বা বদরিকাশ্রম। সংস্কৃতে 'বদর' শব্দের অর্থ কোলিবৃক্ষ বা কুল গাছ। ভগবান বিষ্ণু হিমালয়ের এই তীব্র শীতাঞ্চলে ধ্যানমগ্ন হন। তাঁকে শীত থেকে রক্ষার জন্য লক্ষ্মীদেবী বদরবৃক্ষ-রূপে ছায়া দিতে থাকেন। সহধর্মিণীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান নারায়ণ এই স্থানের নাম দেন বদরিকা- শ্রম। পরে তা বদ্রীনাথধামে পরিচিত হয়।
এখানে গঙ্গামাতার আবির্ভাব উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। হিমালয় থেকে দেবী গঙ্গার পৃথিবীতে আবির্ভাবকে উপলক্ষ করে এই উৎসব।
ভারতের কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে রেলযোগে উত্তরাখণ্ডের হৃষিকেশে যাওয়া যায়। সেখান থেকে গণ-পরিবহনে বদ্রীনাথধামে পৌঁছে বদ্রীনারায়ণের বিগ্রহ দর্শন করা যায়। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী বিগ্রহ দর্শনে আসেন। উল্লেখ্য, বদ্রীনাথধাম বছরে ছয় মাস (এপ্রিলের শেষ থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত) দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। তীব্র শীতের বিরূপ আবহাওয়ার জন্য বাকি ছয় মাস বন্ধ থাকে।
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামনাথপুর জেলার পামবান দ্বীপে রামেশ্বরমধামের অবস্থান। ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পামবান দ্বীপ সেতুর মাধ্যমে যুক্ত। দক্ষিণ ভারতের এই দ্বীপ থেকে শ্রীলঙ্কা মাত্র চল্লিশ কি- লোমিটার দূরে অবস্থিত। দ্বীপের একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে ভারত মহাসাগর। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ পূজিত হন, যা জ্যোতির্লিঙ্গ নামে পরিচিত। এখানে রা- মেশ্বরম-এর পাশাপাশি রামেশ্বরী অর্থাৎ দেবী পার্বতী পূজিতা। মন্দিরে রয়েছে বাইশটি কূপ, যাকে কুন্ড বলা হয়। প্রতিটি কুন্ডের জলের তা- পমাত্রাসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্য আলাদা। ভক্তদের বিশ্বাস, কুণ্ডের জলে স্নান করলে আরোগ্য লাভ হয়।
রামেশ্বরম একটি সমস বদ্ধ শব্দ যিনি রাম তিনিই ঈশ্বর রামেশ্বরম। অতএব রামের নামেই এই ধামের নামকরণ। রামায়ণ অনুসারে লঙ্কেশ্বর রাবণ কর্তৃক অপহৃতা স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারের আগে রামচন্দ্র বানর সৈন্য- দের সাথে নিয়ে এই দ্বীপে জড়ো হন। সীতাকে উদ্ধার শেষে পুনরায় একই স্থানে একত্রিত হন। সেখানে রাবণকে বধের প্রায়শ্চিত্ত করতে শিবলিঙ্গের পূজা করা হয়। সেই লিঙ্গই প্রসিদ্ধ জ্যোতির্লিঙ্গ। এখানে নিত্যপূজা ছাড়াও নানা উৎসবাদি সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়।
কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে সরাসরি রামেশ্বরধামে যাওয়ার ট্রেন পাওয়া যায়।
ভারতের গুজরাট রাজ্যের দ্বারকা জেলায় অবস্থিত দ্বারকাধাম। দ্বারকা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি। দ্বারকা শব্দটি এসেছে দ্বার থেকে। দ্বার অর্থ দরজা। বহু দ্বারের সমন্বয়ে দ্বারকা নগরী সুরক্ষিত হতো। তাই নগরীর নাম দ্বারকা। গোমতী নদী ও আরব সাগরের সঙ্গমস্থ- লেই দ্বারকামন্দির। এখানে দ্বারকাধীশ নামে ভগবান নারায়ণ পূজিত। শঙ্করাচার্য এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সমুদ্রের জলে বহুবার নিমজ্জিত হয় দ্বারকামন্দির। পরে তা পুন- নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে সংস্কারকৃত সেই মন্দির দৃশ্যমান।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে দ্বারকার রাজা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। রাজা হিসেবে তাঁকে দ্বা- কাধীশ বলা হয়। তিনি সমুদ্র থেকে বারো যোজন (৯৬ বর্গ কি.মি.) জায়গা জলশাসনের মাধ্যমে উদ্ধার করে এই নগরী নির্মাণ করেছিলেন।
কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে রেলযোগে আহমেদাবাদ গিয়ে, আহমেদাবাদ থেকে রেলপথে দ্বারকা ধামে পৌঁছানো যায়।
ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী জেলায় জগন্নাথধাম অবস্থিত। বঙ্গোপসাগরের তীরে অত্যন্ত নান্দনিক পরিবেশে এর অবস্থান। জগন্নাথ শব্দের অর্থ জগতের নাথ। ভগবান নারায়ণকেই এখানে জগ- ন্নাথ বলা হয়েছে। জগন্না- থদেবের মন্দিরকে কেন্দ্র করে এখানে জগন্নাথধাম গড়ে উঠেছে।
মন্দিরের প্রাচীরের চারটি দ্বার- সিংহদ্বার, হস্তীদ্বার, অশ্বদ্বার ও ব্যাঘ্রদ্বার। মূল মন্দিরে ওঠার জন্য রয়েছে সুদীর্ঘ সিঁড়ি।
জগন্নাথদেবের বিগ্রহ নির্মাণের একটি পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। কৃষ্ণভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর উপাসনা করতে চান। কিন্তু কোন মূর্তিতে ভজনা করবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এমন সময় ইন্দ্রদ্যুম্মের সামনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন। তিনি ইন্দ্রদ্যুমকে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একখণ্ড কাঠ দিয়ে বিগ্রহ। নির্মাণের আদেশ দেন। এ সময়ে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ইন্দ্রদ্যুম্নের সামনে উপস্থিত হন। তিনি কাষ্ঠখণ্ড থেকে বিগ্রহ নির্মাণের দায়িত্ব নেন। কিন্তু মূর্তি নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কেউ কাজে বাধা দিতে পারবেন না, এই বলে তিনি নির্মাণ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। এদিকে নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই রাজা অস্থির হয়ে ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখতে পান, মূর্তির হাত-পা তৈরি তখনও বাকি। শিল্পীও অনুপস্থিত। এই শিল্পীই দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। পরে সেই অসমাপ্ত মূর্তিই জগন্নাথ নামে জগন্নাথধামে পূজিত হয়ে আসছে।
জগন্নাথদেবের পাশাপাশি এখানে কৃষ্ণভ্রাতা বলরাম এবং কৃষ্ণভগ্নী সুভদ্রার বিগ্রহ রয়েছে।
পুরীর জগন্নাথধামে সারা বছরে মোট বারোটি পার্বণ পালিত হয়। পার্বণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জগন্নাথদে- বের রথযাত্রা। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা হয়। ঐদিন জগন্নাথদেবের বিগ্রহকে বের করে রথে তোলা হয়। সাথে বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহকে রথে তোলা হয়। রথকে রশিতে বেঁধে ভক্তরা তা টেনে নিয়ে যান। সাত দিন পর রথকে টেনে মন্দিরে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। একে বলে উল্টোরথ। লক্ষ লক্ষ ভক্ত রথযাত্রায় যোগ দেন।
কলকাতার হাওড়া থেকে ট্রেনযোগে বা বাসে করে পুরীর জগন্নাথ ধামে যাওয়া যায়।
ছক ২.১৪: শক্তিপীঠদর্শন
শক্তিপীঠগুলোয় যে কারণে ভ্রমণ করতে যাওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি-
|
ছক ২.১৪: তীর্থস্থান ভ্রমণ-পরিকল্পনা
যেখানে যেতে চাই
| যে কারণে যেতে চাই:
|
যেভাবে যাব:
| যা যা করবো:
|
আরও দেখুন...